উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি, হুমকির মুখে থাকা ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী তিন উপজেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা।
বুধবার (১১ আগস্ট) বিকেলে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় এ দাবি করা হয়।
‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ওই সভা থেকে জেলার পাহাড়ি জনপদের বনাঞ্চলে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ, সমতলে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য জেলায় একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে।
নৃগোষ্ঠী নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হরলাল বর্মণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লরেন্স বনোয়ারি। মিঠুন কোচের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঝিনাইগাতী টিডাব্লিওর সাধারণ সম্পাদক অসীম ম্রং, কোচ আদিবাসী ইউনিয়ন জেলা সভাপতি রয়েল কোচ, নারী নেত্রী আইরীন পারভীন, জন-উদ্যোগ আহ্বায়ক ও শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, উদীচী জাতীয় পরিষদ সদস্য এস এম আবু হান্নান, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি সোলায়মান আহমেদ।
এছাড়া নৃগোষ্ঠীদের নেতা সুজল সাংমা, অনেশ রাংসা, পিন্টু নেংমিনজা, সুমন্ত বর্মন, যুগল কিশোর কোচ, পবিত্র বর্মন, মিখায়েল নেংমিনজা লক্ষ্মণ বর্মন, সাংবাদিক হাকিম বাবুল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
নৃগোষ্ঠী নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লরেন্স বনোয়ারি বলেন, “একাত্তরে পাকবাহিনী আমাদের দমাতে পারেনি। আমরা স্বাধীনতা এনেছি। বাঙালি-নৃগোষ্ঠী সবাই মিলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন নিজ দেশে, পরবাসীর মতো হয়ে গেছি। আমরা নৃগোষ্ঠীদের স্বীকৃতি চাই। জমির ওপর আমাদের ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারের অধিকার চাই। এজন্য সবাইকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। যাতে সরকার নৃগোষ্ঠীদের দাবি আদায়ে বাধ্য হয়।”
নৃগোষ্ঠী নেতা সুমন্ত বর্মন বলেন, শেরপুর অঞ্চলে গারো, কোচ, হাজং, বর্মন, বানাই, ডালু ও হদিসহ সাতটি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু এসব নৃগোষ্ঠীর মধ্যে গারো, কোচ, হাজং এবং ডালু জনগোষ্ঠির নিজস্ব ভাষা থাকলেও কালের বিবর্তনে কোনো ধরনের বর্ণমালা সংরক্ষিত না হওয়ায় মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে জেলার পাহাড়ি জনপদে ‘আদিবাসী কালচারাল একাডেমি’ স্থাপন এখন সময়ের দাবি।
সুজল সাংমা বলেন, “আদিবাসীরা সব সময় বিভিন্নভাবে বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়ে আসছে। শেরপুরের পাহাড়ি জনপদে বসবাসকারী অনেক আদিবাসীর জমি জবরদখল করে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বাপ-দাদার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।”
শুধু তা-ই নয়, আদিবাসীদের সন্তানদের মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। অবিলম্বে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার জমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করতে হবে।
রয়েল কোচ বলেন, তালুকদার বাড়ি থেকে দাস বাড়ি হয়ে এখন আমরা নৃগোষ্ঠীদের নাই বাড়ি হয়ে যাচ্ছি। যুগ যুগ ধরে বনাঞ্চলে বসবাসকারি নৃগোষ্ঠীদের এখন বন বিভাগের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানা হবে না। বাপ-দাদা, পূর্ব পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না। এজন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হলেও করব।
শেরপুর পুলিশ লাইনস একাডেমি ফর ক্রিয়েটিভ এডুকেশনের প্রধান শিক্ষক ও জনউদ্যোগ আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতিবৈচিত্র্যে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে দেশের সব নাগরিকের মধ্যে নৃগোষ্ঠীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। দেশের উন্নয়ন ধারায় সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নৃগোষ্ঠীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
উদীচী শিল্পী তৌহিদা স্বাধীনের নেতৃত্বে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। পরে শোকের মাস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যবর্গসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারি আদিবাসী নেতৃবৃন্দের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।
এরপর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী দুইজন নৃগোষ্ঠী বীর মুক্তিযোদ্ধা হরলাল বর্মন এবং লরেন্স বনোয়ারির হাতে জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান নাসরিন রহমানের দেওয়া উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। পরে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে জেলা পরিষদের দেওয়া করোনা সুরক্ষা সামগ্রী মাস্ক, স্যানিটাইজার ও সাবান বিতরণ করা হয়।
আলোচনা সভা শেষে বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় জন্য সার্বজনীন প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনা পরিচালনা করেন গজনী গির্জাঘরের পাস্টার জনার্দন বনোয়ারি।
অন্যদিকে নৃগোষ্ঠীদের দাবির প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, পাহাড়ি জনপদের নৃগোষ্ঠীদের আতঙ্কিত ও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যদি কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভূমিহীন কিংবা ঘরহীন থাকে, তাদের মুজিববর্ষের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে।